Chapter-2 (ইতিহাস)
অনেকের মুখেই হয়ত শোনা যায় বাংলাদেশের শিক্ষাব্যাবস্থার অবস্থা খারাপ। এখন যদি জিজ্ঞেস করা যায় কিভাবে খারাপ, অনেকেই বলতে পারবে না। আসলে ঘটনা টা কি? সবাই এই শিক্ষাব্যবস্থা কে মুখ খিস্তি দেয় কেন? সকালের ঘুমটা ঠিকমত হয় না বলে? টাকা নষ্ট হয় এজন্য? নাকি সময় নষ্ট হয়? নাকি অন্য কিছু?
এই কথাটা পরে বলব। এখন একটা সাধারন ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা যাক। ইন্টার এর পর বাংলাদেশে সাধারনতঃ ছাত্রছাত্রী দের যে ক্লাসিফিকেশন আছে সেগুলো হল, (১) এক দল এডমিশনের জন্য কোচিং এ ছোটে। (২) এক দল গিয়ে জাতীয় বিশ্ব্যবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। (৩) আরেক দল আছে যারা আগে থেকেই জানে এসব করে কোন লাভ নাই, যেয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে ঠাঁই করে নেয়।
এরপর আসি (১) এর দলে। এরা কোচিং শেষ করে সারাদেশ টেস্ট দিয়ে বেড়াবে। এদের আবার ভাগ আছে। (১) এক দল আছে যারা প্রথমেই চান্স পেয়ে যায়।(২) অন্য এক দল।এরা চান্স পায়,কিন্তু মনের মত না।পরের বার আবার চান্স পেতে হবে তাই ভর্তি হয়ে বসে থাকে,ক্লাস করে না। যদি চান্স না পায় তাহলে যেটায় ভর্তি ছিল সেটা কন্টিনিউ করে।(৩) আরেক দল চান্স না পেয়ে প্রাইভেট এ চলে যায় অথবা জাতীয়। (৪) আরেক দল কোথাও চান্স না পেয়ে আবার এডমিশন কোচিং শুরু করে।
এর ভিতর আবার (৪) এর দল তারপরেও কোথাও চান্স না পেয়ে প্রাইভেট এ চলে যায়। সুহান হল সেরকম এর ভিতর একজন। তবে ব্যাপারটা এত সহজে হয়নি। সুহানের ইচ্ছা ছিল সে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়বে। কিন্তু কয়েকটা সমস্যা ছিল। প্রথমত সুহান এর বাড়ির পাশেই একটা পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে যেখান থেকে অনেক অনেক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হয়। সাধারনতঃ বাড়ির পাশে যখন এরকম কিছু থাকে সব মা-বাবা,অভিভাবক স্বপ্ন দেখেন তার সন্তান বাড়ির পাশে এসে চাকরী করুক।
সেদিন সুহান উপজেলা চত্বরে ওয়াইফাই চালাচ্ছিল। তার ছোট কাকু ফোন দিয়ে বলল ভর্তীর ব্যাপারে। তাকে বুঝানো হয়েছিল সে যেন ইলেক্ট্রিকাল ইলেক্ট্রনিক্স এ ভর্তি হয়। খোঁজ নিয়ে জানল ইউনিভার্সিটির CSE এর সিট শেষ। নিরুপায় হয়ে সে এই সাবজেক্ট টাই বেছে নিয়েছিল।
প্রথমের দিকে সে টের পায়নি আসলে ঘটনা টা কি ঘটেছে। কিন্তু পরে বুঝল CSE আর EEE এর মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। তার উপরগ ডিপার্টমেন্ট এর ক্যাঁচাল। বেচারা সারাদিন পড়ে অথচ রেজাল্ট করতে পারে না। ১ম সেমিস্টার এ এর জন্য বাড়িতে কঠিন বকাঝকাও খেতে হয়েছে তাকে। সুহান এটা নিয়ে অনেক মন খারাপ করেছিল। এই এখনও তাকে স্কুল-কলেজের মত বকা খেতে হবে ভার্সিটি উঠে? এই ছিল কপালে?
২য় সেমিস্টার থেকে অবশ্য ব্যাপারটা ঠিক হয়ে গেছিল। তাকে আর বকাঝকা করা হত না। ২য় সেমিস্টার এ সে পড়েছিলও অনেক। কিছুটা খাওয়া-দাওয়া ভুলে পড়ার মত। এর জন্য তাকে যন্ত্রনাও কম পোহাতে হয়নি। সেই সেমিস্টার এ সুহান এর মাঝেমধ্যেই প্রচন্ড মাথাব্যাথা হত। প্যারাসিটামল খেতে খেতে এমন অবস্থা হয়েছিল নর্মাল ডোজ আর কাজই করত না। এরপর সে ক্যাফেইন+প্যারাসিটামল খাওয়া ধরেছিল।
কিছুদিন যেতে যেতে সুহান বুঝল আসলে এত মাথা ঘামিয়ে পড়ার কিছুই নেই। সবই মুখস্থ। কিন্তু সমস্যাটাও শুরু হল সেখানে। সুহানের মুখস্থ বিদ্যা অনেক খারাপ। এইসব প্যাটার্নলেস ম্যাথ,হিস্টোরি,সোসিওলজি নিয়ে ১ম সেমিস্টার থেকেই সে অনেক কনফিউজড ছিল। ২য় সেমিস্টার এ তার রেজাল্ট অবশ্য ভাল হয়েছিল। তবে মাথাব্যাথাটা আরও হল ৩য় তে উঠার পর। সেটা পরের গল্প। তার আগে আমরা সেই প্রশ্নটায় যাই।
সেটা হল, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কেন খারাপ? কয়েকটা কারন আছে। তবে সুহান মনে করে ঠিকমত ম্যাথ না শেখা/শেখানোটা এর অন্যতম কারন। ইন্টারমিডিয়েট এ উঠার পর সুহানকে ম্যাথ নিয়ে ভুগতে হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ফলাফল, সে এখনও পর্যন্ত জানে না ক্যালকুলাস এর ম্যাথ গুলো করার উদ্দেশ্য কি! ক্যালকুলাস এর ফর্মূলা ফিজিক্স এ কেন!
ক্যালকুলাস সম্পর্কে সুহানের আগ্রহ হয় যখন সে মোঃ জাফর ইকবালের গল্পের বই পড়ত। সেখানে লেখা ছিল কিভাবে ১২-১৩ বছরের একটি ছেলেকে তার বাবা ক্যালকুলাস শিখিয়ে দিচ্ছে। অথচ সে নিজে কিছুই জানে না বুঝে না। ইন্টারমিডিয়েট এ উঠে সে ক্যালকুলাস টা অনেক ভাবে ভিজুয়ালাইজ (দৃশ্যমান) করার চেষ্টা করেছে তারপরেও লাভ হয়নি।
উদ্ভাস এ কোচিং করতে গিয়ে যেদিন সে ম্যাথে ফাংশনের ক্লাসটা করতে যায় সেদিন সে টের পায় আসলে ঘটনা কি? এই এতদিন ধরে সে জানতই না যে ফাংশন জিনিসটা কি। অথচ সে এই টপিক ক্লাস ৭/৮ থেকে করে আসছে। তাহলে এতদিন কি করল সে? ম্যাথ মুখস্থ করেছে। তারপরের কাহিনীগুলো আরও ভয়াবহ। সে এই ক্যালকুলাস শেখার জন্য অনেককিছু করেছে। জাপানে ক্যালকুলাস শেখার জন্য একটা কমিক্স আছে, এটাও সে পুরোটা ঘেটে দেখেছে। লাভ হয়নি।
ভার্সিটি তে ভর্তি হওয়ার পর অনেক চেষ্টা করেও সে ম্যাথ এর জটিলতা থেকে রক্ষা পায়নি। ইন্টারে থাকতে সে এক স্যারের কাছে ম্যাথ করত। এখনও সুহান সেই স্যার এর কথা মনে করে। উনিই এর থেকে ভাল ছিলেন। অন্তত নিজে থেকে কিছু বলতেন। এখানে কেও কিছু বলে না। শুধু শীট দেখে বোর্ড এ অংক করানো হয়। এটার কপি এক্সামে ছেড়ে দিলে তারপর পাশ।
ততদিনে সুহান বুঝে গেছে আসলে CSE এর সাথে EEE এর পার্থক্য টা কোথায়। একটা সাবজেক্ট এ প্রোগ্রাম শেখানো হয়। আর একটায় প্রেশার দেওয়া হয় টেলিকমিউনিকেশন আর পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট এ। বাংলাদেশে চাহিদা যেটার বেশি আরকি।
ক্যাম্পাসে উঠার পর সুহান একটা গোঁড়ামীতে ভুগেছিল অনেকদিন। সে ক্যাম্পাসে শুধু পড়তে এসেছে। বন্ধু সে বানাবে না। বান্ধবী তো ভুলেও না। যদিও অনেককে সে পছন্দ করেছে বন্ধু-বান্ধবী হিসেবে, কিন্তু কাওকে সময় দেয়নি। তার রুম মেটদেরকে নিয়েও তার বিশেষ মাথাব্যাথা ছিল না। সারাদিন শুধু পড়ত। আর খুব বেশি খারাপ লাগলে কার্টুন/মুভি দেখে কাটিয়ে দিত। প্রোগ্রাম এর উপর ঝোঁক ছিল অনেক। তাই সময় পেলে ক্যাম্পাস এ কম্পিউটার ল্যাব এ বসে কাজ করত। এই গোঁড়ামীটা অবশ্য ৩য় সেমিস্টার এ এসে উলটে যায়। তারপর থেকেই জীবন এর সাথে তার ভাব হয়। এই কাহিনীটা পরে একসময় বলি।
১ম সেমিস্টার এ সুহান অনেক আপসেট ছিল। কয়েকটা কারনে। আসলেও কি সে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারবে? নাকি মাঝপথে এসে ছেড়ে দিতে হবে? এত টাকা দিয়ে পড়ছে শেষমেষ কি হবে? বাবা-মা কি তাদের কোনকিছু বিক্রি করে দিচ্ছে না তো? এর চাইতে কি ফর্ম টা নিয়ে গিয়ে কুষ্টিয়া চলে যাবে ম্যাথ এ অনার্স করার জন্য..............। এরকম ভাবতে ভাবতে ১ সেমিস্টার পার হউয়ার পর সে বুঝতে পারে এর চাইতে ভাল করে পড়তে হবে। রেজাল্ট করতে হবে। ব্যাস ওয়েভার! তাহলেই হয়ত ঝামেলা ঘুঁচবে।
ব্যাপারটা এতটা সহজ হয়নি তার জন্য। তবে চোখ কান খোলা রেখে সে কয়েকটা ব্যাপার ধরেছিল। প্রথমত, EEE এর মত একটা সাবজেক্ট এ পড়ে এমন কেও কেও আছে যারা কিছু না বুঝেও ভাল রেজাল্ট করে। কেও কেও আছে কোনরকম রেজাল্ট করে বের হোক। তাহলে এদের মূল উদ্দেশ্য কি? আর তার চাইতে বড় কথা এরা পাশ করে কিভাবে? পুরো ক্যাম্পাসে ফার্মেসীতে একটা মেয়ে ছিল যার নাকি সব সেমিস্টার এই রেজাল্ট ৪/৪ থাকত। সে তাহলে কিভাবে পড়ত?
কিছুদিন পর সে টের পায়, বড় ভাইদের সলভ এর ব্যাপারে। সেগুলো পড়েই সবাই পাশ করে। কেও কেও আছে তাদের বন্ধুদের থেকে কোনরকম বুঝে নেয়। আরও একটা ব্যাপার আছে সেটা হল প্রশ্ন রিপিট হয়ে। তার মানে কেও যদি আগের বছরের প্রশ্ন সমাধান করে এক্সাম দিতে যায় তার জন্য ভাল রেজাল্ট করা খুব একটা কঠিন ব্যাপার না। এই থিওরীগুলো ২য় সাময়িক এ তার অনেক কাজে লাগে। তখন সে কোনরকম গুছিয়ে নিতে পারে।
ক্যাম্পাসে আসার পর একটা ব্যাপার নিয়ে তার মেজাজ খারাপ হত। যেকোন প্রোগ্রাম নিয়ে সকলের মাতামাতি। ক্যাম্পাসে যে প্রোগ্রামই হোক না কেন সেটাকেই সে ওয়েভার খাওয়ার একটা ধূর্ততা হিসেবে দেখত। একটা প্রোগ্রাম একটিভেট করতে যে পরিমান সম নষ্ট হয় এর থেকে ৮ ঘন্টা ঘুমানো ভাল। যদিও সোসালাইজেশন এর দোহাই দিয়ে অনেকেই এই প্রোগ্রাম করে, কিন্তু এর জন্য প্রতি সেমিস্টার এ কষ্টটাও কম হয়না। মোটামুটি এভাবেই চলছে সুহানের পড়াশোনা। আর সুহানের মত আরও অনেকের। আচ্ছা এই সবারও কি তাহলে সুহানের মত ইতিহাস আছে? নাকি অন্যরকমও আছে? থাকতে পারে।
এই চ্যাপ্টার এর পিডিএফঃ https://drive.google.com/file/d/0B6i1IEvpnM6zYnJHMkIyamxxbmM/view?usp=drivesdk
চ্যাপ্টার ১ এর লিংকঃ https://drive.google.com/file/d/0B6i1IEvpnM6za2ZrSWgwc0liRms/view?usp=drivesdk
No comments:
Post a Comment